শিবরাত্রি পূজা – বীরভানপুর বয়েজ ক্লাবের ৫ দিনের মহোৎসব
প্রতি বছর বীরভানপুর বয়েজ ক্লাব আয়োজন করে এক বিশাল ও জাঁকজমকপূর্ণ শিবরাত্রি পূজা। এই পবিত্র উৎসবটি ৫ দিন ধরে চলে, যেখানে ধর্মীয় পূজা-পার্বণের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানও অনুষ্ঠিত হয়। শিবরাত্রি পূজার প্রতিটি দিন ভগবান শিবের প্রতি ভক্তি নিবেদনের পাশাপাশি এলাকার মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিকতা, সম্প্রীতি ও আনন্দের বার্তা ছড়িয়ে দেয়। এখানে ৫ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হলো:
প্রথম দিন: কলস যাত্রা
শিবরাত্রি পূজার প্রথম দিনটি শুরু হয় কলস যাত্রার মাধ্যমে, যা গ্রামের মানুষের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। কলস যাত্রার মূল উদ্দেশ্য হলো শিবের আশীর্বাদ লাভ করা এবং পবিত্রতা রক্ষা করা। ভোরবেলা গ্রামের প্রধান শিব মন্দির থেকে গ্রামের পুরোহিত এবং ভক্তরা শুদ্ধ কলস নিয়ে যাত্রা শুরু করেন।
কলস যাত্রাটি গ্রামের প্রত্যেকটি ঘর থেকে শুরু হয়ে গ্রামের সব মানুষের মিলিত অংশগ্রহণে একটি বিশাল মিছিলের আকার ধারণ করে। যাত্রাটি দামোদর নদীর পাড়ে গিয়ে শেষ হয়, যেখানে কলসগুলিকে পবিত্র নদীর জলে পূর্ণ করা হয়। এরপর কলসগুলিকে শিব মন্দিরে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে সেগুলির মাধ্যমে শিবের পূজা করা হয়। এই দিনটি শিব ভক্তদের জন্য অত্যন্ত পবিত্র এবং উৎসবমুখর পরিবেশে কাটে।
দ্বিতীয় দিন: শিবরাত্রি পূজা ও মহাযজ্ঞ
শিবরাত্রি পূজার দ্বিতীয় দিনটি হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিন ভগবান শিবের মহাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। মন্দির প্রাঙ্গণে শিবের বিশেষ পূজা এবং রাত্রি ব্যাপী শিবরাত্রি ব্রত পালন করা হয়। ভক্তরা সারারাত ধরে শিবের মন্ত্র পাঠ করেন, শিবলিঙ্গে জল, দুধ, গঙ্গাজল ও বেলপাতা অর্পণ করেন।
এছাড়াও, এই দিনটি মহাযজ্ঞের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। মহাযজ্ঞের আয়োজন করা হয় সারা রাতব্যাপী, যেখানে গ্রামের মানুষজন একত্রিত হয়ে ভগবান শিবের আশীর্বাদ কামনা করেন। মহাযজ্ঞের মাধ্যমে ভক্তরা নিজেদের পাপমোচন এবং শিবের করুণা প্রার্থনা করেন। পুরো রাতটি একটি আধ্যাত্মিক পরিবেশে ভরে ওঠে, যা শিব ভক্তদের জন্য অত্যন্ত পবিত্র ও শক্তিশালী অভিজ্ঞতা।
তৃতীয় দিন: শিব চর্চা এবং বাউল, কীর্তন, কবিগান
তৃতীয় দিনটি শিব চর্চার জন্য নির্ধারিত। এই দিনে শিবের জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়, এবং ভক্তরা শিবের মহিমা ও আধ্যাত্মিক দিক নিয়ে চর্চা করেন। শিব চর্চা একটি গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক চর্চা, যা শিব ভক্তদের মধ্যে শিবের প্রতি ভক্তি ও আস্থাকে আরও গভীর করে তোলে।
এরপর শুরু হয় বাউল গান, কীর্তন এবং কবিগানের আসর। স্থানীয় এবং আশেপাশের অঞ্চল থেকে বিখ্যাত বাউল ও কীর্তন শিল্পীরা এসে শিবের মহিমা গানের মাধ্যমে ভক্তদের সামনে উপস্থাপন করেন। শিব ভক্তরা এই সময় শিবের প্রতি গভীর ভক্তিতে মগ্ন হন এবং আধ্যাত্মিক আনন্দে ভাসেন। কবিগানের মাধ্যমে শিবের জীবনের বিভিন্ন গল্প ও উপাখ্যান তুলে ধরা হয়।
চতুর্থ দিন: নরনারায়ণ সেবা
শিবরাত্রির চতুর্থ দিনটি হলো নরনারায়ণ সেবা, যা ভগবান শিবের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের একটি সামাজিক দিক। এই দিন প্রায় ৫০০০-এরও বেশি মানুষ একত্রিত হয়ে প্রসাদ গ্রহণ করেন। ক্লাবের পক্ষ থেকে এলাকার গরিব, দরিদ্র ও অভুক্ত মানুষদের মধ্যে মহাপ্রসাদ বিতরণ করা হয়। শিব ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে, মানুষের মধ্যে শিবের প্রতিফলন রয়েছে, এবং তাদের সেবা করা মানেই শিবকে সেবা করা।
এই মহতী উদ্যোগটির মাধ্যমে সমাজের মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, সমানাধিকারের বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়। স্থানীয় মানুষজন ও ক্লাবের সদস্যরা একসঙ্গে এই উদ্যোগে অংশ নেন এবং উৎসবের পরিবেশে সবাই মিলে এক মহা মিলন ঘটে।
পঞ্চম দিন: লোকগীতি ও স্টেজ প্রোগ্রাম
শিবরাত্রির শেষ দিনটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শেষ হয়। এই দিনটি লোকগীতির বিশেষ পরিবেশনা হয়, যেখানে বিখ্যাত লোকগীতি শিল্পীরা তাদের গানের মাধ্যমে শিবরাত্রি পূজাকে আরও আনন্দমুখর করে তোলেন। ২০২৪ সালে বীরভানপুর বয়েজ ক্লাবের স্টেজে বিখ্যাত লোকগীতি শিল্পী অর্পিতা চক্রবর্তী অনুষ্ঠান করেন, যা দর্শকদের মধ্যে বিশেষ আগ্রহ ও আনন্দ সৃষ্টি করে।
পরের বছর ক্লাব আরও বড় স্টেজ প্রোগ্রামের পরিকল্পনা করছে, যাতে বিখ্যাত শিল্পীদের আনা যায় এবং অনুষ্ঠানটিকে আরও জাঁকজমকপূর্ণ করা যায়। শিবরাত্রির এই পাঁচ দিন মানুষের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক চেতনা জাগিয়ে তোলে এবং সকলের মধ্যে এক আনন্দময় পরিবেশ সৃষ্টি করে।
বীরভানপুর বয়েজ ক্লাবের আয়োজিত শিবরাত্রি পূজা শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি আধ্যাত্মিকতা, সামাজিকতা এবং সংস্কৃতির এক অপূর্ব মেলবন্ধন। ৫ দিনব্যাপী এই পূজার প্রতিটি দিন এলাকাবাসী এবং ভক্তদের মধ্যে শিবের করুণা ও আশীর্বাদ পৌঁছে দেয়। বীরভানপুর বয়েজ ক্লাব ভবিষ্যতেও এই পূজা আয়োজনের মাধ্যমে শিব ভক্তদের আধ্যাত্মিক আনন্দ দেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
Our Gallery: